আটশত বছরের ইসলামিক ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে ভরপুর স্পেনের আভিলা ভ্রমণ



( আমার আলিকান্তে থেকে মাদ্রিদ হয়ে আভিলা তে যাওয়ার পথে যাত্রা বিরতিতে)
বাস স্টেশন শহরের দেয়াল থেকে পাঁচ মিনিট এর হাঁটার পথ, ট্রেন স্টেশন থেকে আরও পাঁচ মিনিট এর দূরত্ব। খারদিন দেল রেক্রেও থেকে দুকে দে আল্বা এর দিকে হেঁটে গেলাম প্লাছা দে সান্তা তেরেসা এর দিকে। এখান থেকেই পুএরতা দেল আল্কাছার এর মাধ্যমে আভিলা তে প্রবেশ করলাম।


মনে পড়ল মেস্কিতা দে আভিলার বা আভিলার মসজিদের কথা, ( কাইয়ে গারসিলাসো দে লা ভেগা, ২৬, ০৫০০৩ আভিলা), মনে পরল কি ভাবে মুসলমানরা ইসলামিক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য দিয়ে কিভাবে এই আভিলাকে ভরপুর করে দিয়েছিল ! নগরীর সবচেয়ে বড় ঐতিহাসিক প্রভাবগুলি ইসলামী সংস্কৃতির ! ! মুসলমানরাই ছিলেন অষ্টম শতাব্দী থেকে পনেরশ শতাব্দী পর্যন্ত, আটশত বছর এই আভিলাতে একমাত্র প্রভাবশালী।
 ( আভিলাতে ভ্রমণরত অবস্থায় আমি)
যখন গেটের ভিতরে দিয়ে প্রবেশ করলাম, বা দিকে , ক্যাথেড্রাল এর দিকে তাকালাম, বা দিকে ঘুরে পেলাম, প্লাছা দে লা ক্যাথেড্রাল এর দিকে। প্রধান বাজারটি পেলাম হাতের বা দিকে, শুক্রবার , প্লাছা দেল মেরকাদো চিকো তে খোলা বাজার , দুপুরের খাবার এর জন্য দুর্দান্ত এক জায়গা।


পুরোপুরি সংরক্ষিত দেয়ালের অভ্যন্তরে, এমন একটি জগতে গেলাম, যেখানে সময় এখনও থমকে দাঁড়িয়ে আছে বলে মনে হল। প্রাচীন রামপালগুলি অনেক ঐতিহাসিক আকর্ষণকে রক্ষণাবেক্ষণ করছে - রোমানাস্ক গীর্জা, মধ্যযুগীয় ধর্মান্তরিত এবং রেনেসাঁ প্রাসাদগুলি। ব্যতিক্রমী স্মৃতিস্তম্ভ এবং ওল্ড ওয়ার্ল্ড পরিবেশের সম্পদ ইউনেস্কো-তালিকাভুক্ত আভিলা, স্পেনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় শহরগুলোর মধ্যে শুক্রবারে প্লাজা ডেল মার্কাডো চিকো তে আমি ! ! ! বিশ্ব বিখ্যাত প্রাচীর অভ্যন্তরে পাওয়া শতাব্দীর শৈল্পিক এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রাচীনতম এবং সবচেয়ে সুন্দর শহরগুলির মধ্যে একটি স্পেনের আভিলা । প্রাচীনতম শহরগুলোর মধ্যে একটি।

তিনটি জিনিস অবাক বিস্ময়ে উপভোগ করলাম আভিলাতেঃ
- শহরের দেয়াল ঘেঁষে হাটা, যা পুয়ের্তা ডেল কারমেন আর পুয়ের্তা দে লস লেয়ালেস এর মধ্যে দিয়ে গিয়েছে। 


- শহরটকে সুরক্ষিত করার জন্য অনেকগুলি খিলানপথ ( আর্চওয়েস), বুরুজ তুররেটস পেলাম, যা ঘুরে দেখার মত।


আর


- কনভেন্টো দে সান্তা টেরেসা
 ( আভিলাতে ভ্রমণরত অবস্থায় আমি)
দর্শনীয় স্থান সমুহের মধ্যে আরো দেখলামঃ

১। ক্যাথেড্রাল দে সান সাল্ভাদর।
২। মুরাইয়াস ( টাউন ওয়ালস)
৩। কনভেন্তো দে সান্তা তেরেসা
৪। রিয়েল মোনাস্তেরিও দে সান্তো টমাস।
৫। বাসিয়িকা দে সান ভিসেন্তে।
৬। বারিও খুদিও ( জিউস কোয়ার্টার)
৭। কাপিয়া দে মোসেন রুবি দে ব্রাকামন্তে
৮। লাস গর্ডিলাসের ১৬তম শতাব্দীর কনভেন্ট
৯। কনভেন্টো দে সান্তা মারিয়ার গ্রাসিয়া
১০। ইগ্লসিয়া দে সান আন্দ্রে


এই আভিলাতেই জন্মেছিলেনঃ

১। ব্লাস্কো নুনিয়েজ ভেলা, যিনি ছিলেন পেরুর প্রথম ভাইসরয়
২। পেদ্রো দে ভিয়াগ্রা, একসময়ে যিনি ছিলেন চিলির গভর্নর
৩। খোয়ান দে মালদোনাদো, যিনি ছিলেন ভেনিজুয়েলার একটি শহর সান ক্রিস্টোবাল এর প্রতিষ্ঠাতা
৪। সন্সলেস এস্পিনোসা, যিনি ছিলেন স্পেনের সাবেক প্রধান মন্ত্রী খোসে লুইস রড্রিগুয়েজ ছাপাতেরো এর স্ত্রী।
( আভিলাতে ভ্রমণরত অবস্থায় আমি)

স্পেনের মাদ্রিদ থেকে আভিলা তে আপনি ও যেতে পারেন। কিভাবে যাবেন?
- ট্যাক্সিতে যেতে পারেন। আ করোনিয়ার পথ ধরুন, এম ৩০। এ ৬ এর পূর্বেই দেখতে পাবেন আভিলা। আপনি চাইলেই গাড়ি (ইজিকার) ভাড়া পেতে পারেন, দাম প্রশংসনীয় প্রতিযোগিতামূলক ।
- ট্রেনেও যেতে পারেন। লোকাল ট্রেন নেটওয়ার্ক এর ছেরকানিয়াস এর লাইন সি ৮ ধরুন। ট্রেন পাবেন আতোচা, রেকোলেতস, চামারতিন বা নুয়েভোস মিনিস্তেরিওস এ


- বাসে ও যেতে পারেন। মেন্দেয আল্ভারো মেট্রো স্টপ এ যে বাস ষ্টেশন আছে, সেখনে বাস কোম্পানি আভাঞ্ছা এর বাস সার্ভিস পাবেন মাদ্রিদ থেকে আভিলা।


- হিচ হাইকিং করেও যেতে পারেন। হিচ হাইকিং এর জন্য স্পেন একটি আদর্শ দেশ।



আভিলা থেকে কোথায় যাবেন?
আভিলা থেকে সালামাঙ্কা ট্রেনে মাত্র ১ ঘণ্টার পথ। আভিলা থেকে আপনি যদি মাদ্রিদ যেতে চান, তবে সালামাঙ্কা এক রাত থেকে পরের দিন মাদ্রিদ যেতে পারেন।


আভিলা থেকে সেগভিয়া, বাসে মাত্র এক ঘণ্টার পথ।
( আভিলাতে ভ্রমণরত অবস্থায় আমি)

আভিলা, স্পেনঃ
স্পেনের বিভিন্ন স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল বা বিভাগগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় ক্যাস্টিল এন্ড লিওন। এর যে পাশে মাদ্রিদ অবস্থিত, সে পাশেই আছে পুরনো ঐতিশহরটির পত্তন হয় খ্রিষ্টের জন্মেরও ৫শ বছর আগে। তখন শহরটি ভেটনদের অধিকারে ছিল। পরে আভিলা রোমানদের অধীনে আসে। তখন শহরটি হিস্পানিক বা স্প্যানিশ লুসিতানিয়ার অন্তর্গত ছিল। প্রাচীন রোমের আবুলা, আবিলা, আবেলা, আবলা নামের যে সব শহরের উল্লেখ পাওয়া যায়, ধারণা করা হয় সবগুলোই আসলে এই আভিলা। পরে ৭১৪ খ্রিস্টাব্দে আরবরা শহরটির দখল নেয়। আভিলা আরবের মুসলিম শাসকদের অধীনস্ত থাকে এরপর প্রায় সাড়ে ৩শ বছর। উত্তরের আইবেরিয়ান-খ্রিস্টান রাজ্যগুলো আভিলা দখলে চেষ্টায় ত্রুটি করেনি। কিন্তু তাদের কোনো আক্রমণই ফলপ্রসূ হয়নি। শেষ পর্যন্ত সেই অসাধ্য সাধন করেন ক্যাস্টিল এন্ড লিওনের রাজা ষষ্ঠ আলফনসো, ১০৮৮ সালে।


অনেক সাধনায় পাওয়া এই আভিলা আরেক দফা হাতছাড়া হওয়ার কোনো ঝুঁকি নিতে রাজি ছিলেন না রাজা আলফনসো। তাই আভিলা দখল করার পরপরই তার বোন-জামাই রেমন্ডকে দায়িত্ব দেন শহরটিকে সুরক্ষিত করে গড়ে তুলতে। বার্গান্ডির যুবরাজ রেমন্ড নিজেও কম বিখ্যাত নন। তিনি দূর দেশ থেকে দুজন কারিগরকে ডাকিয়ে আনেন- কাসান্দ্রো রোমানো এবং ফ্লোরিন দ্য পিতুয়েঙ্গা। তাদের দায়িত্ব দেন শহরের চারপাশ ঘিরে শক্তিশালী পাথুরে দেয়াল তুলতে। দুই কারিগরও এক দশকের মধ্যেই পুরো আভিলাকে আয়তাকার দেয়াল দিয়ে ঘিরে ফেললেন।
 ( আভিলাতে ভ্রমণরত অবস্থায় আমি)

আভিলার প্রাচীরঃ
স্পেনের আভিলা নগরী প্রাচীর দিয়ে ঘিরে দেয়া হয়েছিলো ১২ শতকে। নিম্ন শ্রেণির প্রজাদের সঙ্গে লিওন সা¤্রাজ্যের যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে স্থানীয়দের রক্ষার জন্য এটি নির্মিত হয়। প্রাচীরের সঙ্গে নিরাপত্তা চৌকি আছে। প্রায় ১ হাজার বছর পর পুরো শহরটি প্রাচীর দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়। তবে মধ্যযুগীয় সেই প্রাচীর টিকে আছে আজো। নগরের নিরাপত্তার জন্যই নির্মাণ করা হয়েছিলো এই প্রাচীর। তখন দূর্গনগরী আভিলার সঙ্গে যুদ্ধ চলছিলো লেওন রাজ্যের। তবে এই প্রাচীরের শেষাংশ নির্মিত হয় প্রায় ১ হাজার বছর পর। আর এতে এই নগরী হয়েওঠে প্রকৃত সুরক্ষিত শহর।


আভিলার চারপাশ দিয়ে আড়াই হাজার মিটারের এই দেয়াল শহরটিকে রীতিমতো দূর্গ বানিয়ে তুলেছে। এই দেয়াল ১০ ফুট পর্যন্ত চওড়া, ৪০ ফুট পর্যন্ত লম্বা। দূর্গের প্রাচীরে যেমন চলাচলের পথ থাকে, দেয়ালের উপরে তেমনি পথও আছে। আছে ৮৮টা প্রতিরক্ষা টাওয়ার। আয়তাকার দেয়ালের বিভিন্ন দিকে মোট ৮টা প্রবেশদ্বার আছে। এই প্রবেশদ্বার ছাড়া শহরে প্রবেশ করার অন্য কোনো পথই নেই। পুরো শহরটাই যে দেয়াল দিয়ে ঘেরা। সব মিলিয়ে নির্দিষ্ট দূরত্বে অবস্থিত এই টাওয়ারগুলো দেয়ালটাকে সত্যিই একটা দূর্গ-প্রাচীরের চেহারা দিয়েছে।
(আভিলা থেকে আলিকান্তে ফেরার পথে আমি)
পরে অবশ্য এই দেয়ালের বাইরেও শহরের বিস্তার ঘটেছে। শহরের দেয়াল ঘেরাটা অংশটা এখন পুরনো আভিলা বা ওল্ডটাউন হিসেবে পরিচিত। আর স্বাভাবিকভাবেই শহরের সব ঐতিহাসিক স্থাপনাও এই দেয়াল-ঘেরা পুরনো আভিলায় অবস্থিত। সে সব স্থাপনার মধ্যে আছে গথিক রীতিতে বানানো পুরনো ক্যাথেড্রাল, সেন্ট থমাসের গির্জা, থমাস দ্য তরকেমাদা-র সমাধি এবং ডন জুয়ানের সমাধি। এদের মধ্যে থমাস দ্য তরকেমাদা ছিলেন সমগ্র স্পেনের প্রথম প্রধান বিচারক। আর ডন জুয়ান ছিলেন স্পেনের রাজা ফার্দিনান্দ ও রানি ইসাবেলার একমাত্র সন্তান। আরও আছে রোমান রীতিতে বানানো অনেকগুলো চার্চ।


আভিলার সেই ঐতিহাসিক দেয়াল অটুট আছে এখনো। দেয়ালের অর্ধেকটার উপরের পথে এখনো ঘুরে বেড়ানো যায়। এখন আবার পুরো দেয়াল জুড়েই হলদে-কমলা হ্যালোজেন বাতি লাগানো হয়েছে। রাত হলেই পুরো দেয়ালে হলদে-কমলা আলো জ্বলে ওঠে। আনুষ্ঠানিকভাবেই এই দেয়াল এখন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আলোকিত স্থাপনা। ১৯৮৫ সালে শুধু এই দেয়ালটাকেই না, বরং দেয়ালসমেত পুরো পুরনো আভিলাকেই ইউনেস্কো ঘোষণা করেছে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে।


এখন নিরাপত্তা প্রাচীরে ঘেরা এই শহরটি খুব শান্ত এবং এর পরিবেশ খুবই আন্তরিক। রাতে একদম স্তব্ধ থাকে। তবে শহরের দক্ষিণে বর্তমানে দ্রুত গতিতে উন্নয়ন হচ্ছে। যে কারণে প্রাচীরঘেরা শহর ছেড়ে নতুন প্রজন্ম সেদিকেই ঝুঁকছে।

Comments

Popular posts from this blog

কলকাতা ভ্রমণ

বাল্টিক সাগরের মুক্তো লাটভিয়ার রাজধানী রিগাতে ভ্রমণ

রুদা নদীর তীরে "সবুজ" শহর খ্যাত দক্ষিণপশ্চিম পোল্যান্ডের সিলেসিয়ান ভয়েডেডশিপের শহর রিবনিক ভ্রমণ